ডেঙ্গু- যেসব তথ্য অবশ্যই জানতে হবে

https://www.pexels.com/

মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস, বিশেষ করে গরম ও বর্ষা এই দুই সময় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। বর্ষাকাল আসতে এখনও মাস দুয়েক সময় আছে। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখনই শুরু হয়ে গেছে। গতবছর এই সময় যতজন ডেঙ্গু রোগী ছিল এই বছর তার চারগুণ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের থেকে সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৩ জন।

বিগত বছরগুলোতে রোগটির প্রাদুর্ভাব রাজধানী ঢাকাতে বেশি হলেও গতবছর ঈদযাত্রায় এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর সারা দেশেই এই মশা ডিম পেড়েছে। এই ডিমগুলো প্রতিকূল পরিবেশেও সুপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে পারে। বর্ষা আসলেই যখন বিভিন্ন জায়গায় পানি জমতে শুরু করবে তখনই ডিমগুলো থেকে মশা বেরিয়ে আসবে। ফলস্বরূপ এই বছর সারা দেশেই ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। যাদের মধ্যে ৪৯ হাজার ৫৪৪ জন ছিলেন ঢাকার বাইরে। আক্রান্তদের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫ লাখ মানুষ হেমোরেজিক জ্বরে ভোগে এবং কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে শিশু।

এডিস মশার বিস্তারের মাত্রা এখনও কম, তাই এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সঠিক সময়। বর্ষাকালে এটি আরও ছড়িয়ে পড়লে তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।

 

ডেঙ্গু কি?

ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। এডিস মশাবাহিত ৪ ধরণের ভাইরাসের যে কোনও একটির সংক্রমণে যে অসুস্থতা হয় সেটাই ডেঙ্গু। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। আবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।

ডেঙ্গুজ্বরের দুটো ধরণ রয়েছে- ১। ক্লিনিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর ও ২। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর ।

কার্যত ডেঙ্গুজ্বরের এখনও তেমন কোন প্রতিষেধক নেই। অন্য ভাইরাল জ্বরের মতো এটিও আপনা-আপনিই সেরে যায় সাত দিনের মধ্যে। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর ভয়াবহ হতে পারে।

 

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ-

ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর কম হতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে তীব্র জ্বরও হতে পারে। তীব্র জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১০৪ ডিগ্রি-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাবার পর হঠাৎ করে আবার জ্বর আসতে পারে। জ্বরের সঙ্গে প্রচন্ড মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথাও থাকে। চোখেও ব্যথা থাকে, চোখ নাড়ালে বা এদিক ওদিক তাকালে ব্যথা করে। অরুচি, গলা ব্যথা ও বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গুজ্বর ৩-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। জ্বর দুই তিনদিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাল লাল ছোপ দেখা দিতে পারে। এই সময় রক্তের প্লাটিলেটও দ্রুত কমতে থাকে।

জ্বর যদি জটিল পর্যায়ে যায় তাহলে অন্য সমস্যার পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হতে পারে। যেমন: চামড়ার নিচে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, নাক ও মুখ দিয়ে, কফের সঙ্গে, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে ও চোখের বাইরে, বমির সাথে রক্ত পড়তে পারে।

অবস্থা অনেক গুরুতর হলে অনেক সময় বুকে বা পেটে পানি আসতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতাও দেখা দিতে পারে।

 

চিকিৎসা

ডেঙ্গুর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। ডেঙ্গুজরে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জ্বর ততটা মারাত্মক হয় না, এমনকি কোন চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে হ্যাঁ, গতবছর একটু ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জন মারা গেছে। তাই ডেঙ্গু রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে যাতে করে ডেঙ্গুজনিত কোন মারাত্মক জটিলতা না হয়।

১। প্রচুর পরিমাণে পানি, লেবুর শরবত, ফলের রস, ডাবেরপানি ও তরলখাবার খেতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, আর পানিশূন্যতা হলে কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই ডেঙ্গু রোগীকে ২.৫ থেকে ৩.৫ লিটার তরল খাবার নিশ্চিত করতে হবে। এটিই ডেঙ্গুর আসল চিকিৎসা। না খেতে পারলে স্যালাইন দিতে হবে।

২। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে হবে। (জ্বর চলাকালীন এবং জ্বরের পর এক সপ্তাহ)

৩। জ্বর কমানোর জন্য বা ব্যথানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না। এসপিরিন বা ক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে।

৪। জ্বর কমানোর জন্য বারবার গা মোছাতে হবে ভেজা কাপড় দিয়ে।

** ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। কারণ এসব রোগীকে কোনও স্বাভাবিক এডিস মশা কামড় দিলে সেই মশাটিও ডেঙ্গুর জীবাণুর বাহক হয়ে যাবে এবং তখন ঐ মশাটি সুস্থ কোন ব্যক্তিকে কামড় দিলে সুস্থ ব্যক্তিটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে।

 

কি কি লক্ষণ দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে

১। রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে ।

২। প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে। এক্ষেত্রে রোগীকে শিরাপথে সেলাইন, প্রয়োজনে রক্তের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন করতে হতে পারে।

৩। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।

৪। অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।

৫। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।

৬। শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি এলে।

৭। জন্ডিস দেখা দিলে।

৮। রক্তচাপ কমে গেলে।

 

প্রতিরোধ ব্যবস্থা:

১। এসিড মশা নোংরা পানিতে জন্ম গ্রহণ করে না। এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। বৃষ্টি হলে বাসা-বাড়ির আঙ্গিনায় কোন পাত্রে তিন থেকে চার দিন পানি জমে থাকলে সেই পানি ডেঙ্গুর বংশ বিস্তারের জন্য উপযুক্ত জায়গা। এজন্য লক্ষ রাখতে হবে যেন বৃষ্টির পানি জমে না থাকে। তাই বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে এমন জিনিস যেমন- ফুলের টব, কৃত্রিম পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, ভাঙ্গা ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, গাছের কোঠর, বাঁশের গোড়ার কোঠর, বাসার ছাদ, ডাবের খোল ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।

২। বাথরুমে বা কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।

৩। এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তাই এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে অন্য সময় এডিস মশা কামড়ায় না। অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই ডেঙ্গুর সিজনে শরীর ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মশা দূরকারী ক্রিম (মসকুইটো রিপেলেন্ট) ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪। ঘরের দরজা-জানালায় নেট লাগিয়ে নিতে পারেন।

৫। মশার স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করতে হবে।

৬। মশারির কোন বিকল্প নেই। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। এমনকি দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। বাজারে পাওয়া বেশির ভাগ মশা দূর করার উপাদান, যেমন এরোসল স্পে, মশার কয়েল ইত্যাদির কার্যকারিতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন থেকে যায়। তাই সবার আগে মশারি নিশ্চিত করতে হবে।

৭। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

৮। প্রয়োজনে যেসব স্থানে জমে থাকা পানিতে মশার বংশ বিস্তার ঘটতে পারে সেসব জায়গায় মশা নিধক ওষুধ ছিটিয়ে দিতে হবে।

৯। বাড়ির আশপাশে নদর্মা ও আবদ্ধ জলাশয় থাকলে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে।

১০। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

সুত্র- The Daily Star , প্রথম আলো , যুগান্তর , দৈনিক ইনকিলাব

 

HalchalBD

We are a group of professionals, decided to share our knowledge and interests for your better being.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Next Post

সহজেই মজাদার বিরিয়ানি

Thu Mar 26 , 2020
বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বিরিয়ানি বানানোটা অনেকের কাছেই একটু কঠিন এবং ঝামেলার কাজ মনে হয়। মনে হয় অনেক প্রিপারেশন নিতে হবে তারপর রান্না করতে হবে। এই বিরিয়ানিই কিন্তু অনেক সহজেই কম সময়ে রান্না করা যায় এবং এর স্বাদও অসাধারণ হয়। তাই এখন হঠাৎ […]

You May Like

error: Content is protected !!